‘তাবলীগ’ অনুসারীদের একটি বৃহত্তম সমাবেশ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা। তাবলীগ আরবি শব্দ, বালাগ শব্দ থেকে আগত। যার শাব্দিক অর্থ পৌঁছানো, প্রচার করা, প্রসার করা, বয়ান করা, চেষ্টা করা, দান করা ইত্যাদি।
পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানোকে তাবলীগ বলে। বিশ্বনবী (স.) এ প্রেক্ষিতে বলেছেন, আমার পক্ষ হতে একটিমাত্র বাণী হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।
টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্ব ইজতেমা। ২০১১ সাল থেকে এক সাথে এতো ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্কুলান না হওয়ায় দু’ পর্বে ইজতেমা চলার সিদ্ধান্ত হয়।
সেই ধারাবাহিকতায়ই এবার মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ইজতেমার ইতিহাস
আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস (রাহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামী দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় তা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দিন দিনি বাড়তে থাকে তাবলিগের প্রচার-প্রসার ও ব্যাপকতা। তাবলিগের সাথী সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীতে ইজতেমা আয়োজন শুরু হয়।
বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা
বিশ্ব ইজতেমার ১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে তাবলিগের দাওয়াতি কাজ শুরু হয়। আর তা ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদ থেকে যাত্রা শুরু করে। তৎকালীন সময়ে মাওলানা আব্দুল আজিজ (রাহ.) বাংলাদেশে ইজতিমার হাল ধরেন। তখন থেকেই বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা আরম্ভ হয়।
১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে প্রথমবারের মতো তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।
২ বছর অতিক্রম হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে চট্টগামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে দ্বিতীয়বারের মতো তাবলিগের সম্মেলন বা ইজতেমার আয়োজন করা হয়।
তার ১০ বছর পর ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতিমা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সময়ে তাবলিগের এ সম্মেলন শুধুমাত্র ইজতেমা নামেই প্রচার ও পরিচিত ছিল।
বিশ্ব ইজতেমা
তাবলিগের প্রচার-প্রচারণা দিন দিন প্রসারিত হতে থাকে। বাড়তে থাকে তাবলিগের সাথী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সংখ্যা।
এ কারণে ৮ বছর পর ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতিমা আয়োজন করা হয়। সে বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগের এ ইজতেমায় ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও তাবলিগের সাথীরা অংশ গ্রহণ করে।
আর সে বছর থেকেই এ ইজতেমাকে বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে এ ইজতেমা।
১৯৬৬ সালের পর থেকে প্রতি বছরই টঙ্গীর তুরাগ নদীর উত্তর পূর্ব তীর সংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু জমি মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ ইজতেমা। যা বিশ্ব ইজতেমা নামে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
সে হিসাবে বিশ্ব ইজতেমার ২০১৮ সালে ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিদেশি মেহমান ও রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বছর ১০১ দেশ থেকে ইজতেমা অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে এ ইজতিমায়।
২ ধাপে ইজতেমা আয়োজনের পরও মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি হওয়ায় ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর ৩২ জেলার অংশগ্রহণে ২ ধাপে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এর ফলে প্রতিটি জেলা এক বছর পর পর টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমায় উপস্থিত হতে পারবে।
যে সব জেলা টঙ্গীর বিশ্বে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাদের জন্য জেলাভিত্তিক আঞ্চলিক ইজতেমার আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। সে আলোকে গত ২বছর ধরে জেলাভিত্তিক আঞ্চলিক ইজতেমাও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব
পাঁচ দিন বিরতির পর আজ শুক্রবার সকালে গাজীপুরের টঙ্গীতে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা। এ পর্বে অংশ নিতে আসা মুসল্লিতে ভরে যায় পুরো ইজতেমা মাঠ। ইজতেমার জামাতের সঙ্গে জুমার নামাজ পড়তে সকাল থেকে দল বেঁধে ইজতেমা মাঠে আসতে থাকেন রাজধানী ও আশপাশের এলাকার মুসল্লিরা।
একপর্যায়ে মাঠে জায়গা না পেয়ে অনেকে যেখানে ছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েন। জায়গা না পেয়ে অনেকেই বসে পড়েন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কামারপাড়া-মন্নুগেট সড়ক ও আশপাশের অলিগলিতে। ইজতেমা চলবে আগামী রোববার পর্যন্ত।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে এ পর্যন্ত সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, কাতার, জর্ডান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ৬১টি দেশের সাত হাজার সাত শত পঁচিশ জন বিদেশী মেহমান ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। এবং অনেকেই এখনো পথে রয়েছেন। অনেকেই আখেরী মোনাজাতের আগ পর্যন্ত ময়দানে আসবেন।
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের গণমাধ্যম বিষয়ক সমন্বয়কারী মো: সায়েম এর সাথে যোগাযোগ করলে বিদেশী মেহমানের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সাত হাজার সাতশত পঁচিশ জন বিদেশী মেহমান ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন, অনেকেই পথে রয়েছে। আগামীকাল রবিবার দুপুরের পূর্বে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। মোনাজাত পরিচালনকা করবেন সা’দ সাহেবের বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সা’দ কান্ধলবী।
ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক আব্দুর রাজ্জাক (৫৫) বলেন, দ্বিনের মেহনতে আল্লাহকে রাজি খুশি করতে তাবলিগের দাওয়াতে বেরিয়েছি। টঙ্গীর ইজতেমা শেষে আমরা ভারতে অবস্থান নেবো। আমাদের চিল্লার সময় শেষ হলে দেশে ফিরবো। আমি এ পর্যন্ত টঙ্গীর ইজতেমায় তিন এসেছি। আল্লাহ তৌফিক দিলে আবার আসবো।