ঢাকার রাস্তায় অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবার ও কালুর হাতকড়া বিতর্ক

0
64
অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবার ও কালুর হাতকড়া বিতর্ক

সম্প্রতি ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় এক ভিনদেশি ট্রাভেল ভ্লগারকে ‘উত্যক্ত করার‘ একটি ভিডিও এবং পরবর্তীতে ‘উত্যক্তকারী’ সে ব্যক্তিকে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতারের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবার ও কালুর হাতকড়া বিতর্ক চলছে।

যে ব্যক্তিকে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল তার নাম আব্দুল কালু এবং বয়স ৬০ বছর।

কেউ বলছেন, এ ব্যক্তির বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে পর্যটকরা ‘হয়রানি’ থেকে রেহাই পাবেন। আবার আরেক পক্ষের মত হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিবাজদের না ধরে শুধু গরিব মানুষের ওপরেই আইন প্রয়োগ হচ্ছে।

গত ২০শে মার্চ ল্যুক ড‍ামান্ট নামে ওই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ও ভ্লগার বাংলাদেশে আসেন তবে তাকে হয়রানির ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৮শে মার্চ ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায়।

ভিডিওতে কী আছে?

অস্ট্রেলিয়ান ভ্লগার ল্যুক ডামান্ট যে ভিডিও দিয়েছেন সেখানে বিষয়টি উঠে আসে।

ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় একজন কেক বিক্রেতার কেক বানানোর ভিডিও করার সময় আব্দুল কালু নামে এক বয়স্ক ব্যক্তি তার সামনে আসেন।

মি. কালু ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে অস্ট্রেলিয়ার সে পর্যটককে স্বাগত জানান এবং নানা বিষয়ে কথা বলতে থাকেন।

মি. ডামান্ট কেক কিনে খাওয়ার পর ওই দোকানিকে ৫০০ টাকার নোট দিয়ে পুরোটা রেখে দিতে বলেন। কিন্তু মি. কালু দোকানির ইংরেজি না বোঝার সুযোগ নিয়ে সেখানে ভাগ বসান।

এরপর ডামান্ট সেখান থেকে চলে যাওয়ার মি কালুকে তার পিছু পিছু আসতে দেখা যায় । একপর্যায়ে পারিবারিক অভাবের কথা বলে মি. ডামান্টের কাছে ৫০০ টাকা চাইতে থাকেন।

মি. ডামান্ট তাকে ২০-৩০ টাকা ধরিয়ে দিলে মি. কালু তা নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং আরও টাকা দাবি করেন।এই ভিনদেশি পর্যটক বারবার বিরক্তি কণ্ঠে তাকে একা ছেড়ে দিতে বললেও ওই বৃদ্ধ দীর্ঘ পথ অনুসরণ করে অনবরত ‘উত্যক্ত’ করতে থাকেন।

পরদিন ২৯শে মার্চ মি. ডামান্ট তার ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেইজে ‘এভোয়েড দিস ম্যান ইন বাংলাদেশ’ অর্থাৎ “বাংলাদেশে এই মানুষটিকে এড়িয়ে চলুন” শিরোনামে একটি ভিডিও আপলোড করেন।

ল্যুক ডামান্টের ফেসবুক পেইজে প্রায় ৩৩ লাখ ফলোয়ার। তাই ওই ভিডিওটি আপলোড হওয়ার সাথে সাথে সেটি ভাইরাল হয়ে যায়।

পাঁচদিনের মাথায় ভিডিওটি দেখা হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ বারের বেশি। শেয়ার হয়েছে ২০ হাজার বার। কমেন্ট ও রিয়্যাক্ট পড়েছে সাত লাখের মতো।

অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবার ও কালুর হাতকড়া বিতর্ক

ভিডিওটি টুরিস্ট পুলিশের নজরে এলে তারা তেজগাঁও থানা পুলিশকে জানায়। পরে তেজগাঁও পুলিশের একটি দল হাতিরঝিল থানার সহযোগিতায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।

সোমবার কালুকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে তিনি নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করেন। পরে ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালত তাকে ২০০ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক দিনের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

মি. কালুকে গ্রেফতার করায় টুরিস্ট পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন লুক ডামান্ট। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ খবর জানিয়ে লিখেছেন, আপনাদের সুন্দর দেশটিতে পর্যটকদের আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নিশ্চিতের জন্য আপনাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।”

আব্দুল কালুর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তাকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের গাড়িতে করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়।

তার হাতে হাতকড়া পরানো একটি ছবি প্রকাশ পেলে সেটি নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে শোরগোল তোলেন নেটিজেনরা, এরমধ্যে তানভীর আহমেদ প্রিন্স তাকে পুলিশের তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে বলেছেন,

“উনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মত কাজ করেছে। এটা অপরাধ। এই লোকটার মত অনেক দালাল আছে যারা দেশের ট্যুরিজম সেক্টরকে শেষ করে দিচ্ছে।”

অর্ণব দাস নামে একটি আইডি থেকে বলা হয়, “ট্যুরিজম ব্যবস্থার সাথে জড়িত আছি বেশ কিছু সময় ধরে। আমি লজ্জায় পুরো ভিডিও দেখতে পারিনি।”

তবে এই বৃদ্ধ লোকটিকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন অনেকে।

মোহাম্মদ মাসুদ রানা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “চোরেরা, হাজার কোটি টাকা মেরে দিলে চোখে পড়ে না, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না। চোরদের ১০ বছরেও খুঁজে বের করতে পারেন না। শুধু কালু মিয়া অস্ট্রেলিয়ান ভ্লগারের কাছে ৫০০ টাকা চাইলেই তোমাদের ইজ্জৎ যায়। তার ঘরে দুইদিন ধরে ভাত নাই,তার জন্য আমাদের ইজ্জৎ যায়না।”

আবার জিয়া হকও টুরিস্ট পুলিশদের অন্যান্য দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তার পোস্টে।

তিনি লিখেছেন, “আরও অনেক অনেক কারণে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বিদেশি পর্যটকদের কাছে। যার শুরুটাই হয় বিমান থেকে নামার পর এয়ারপোর্টের গেট থেকেই, এরপর তো আছেই। সেগুলোর দিকে অবশ্যই টুরিস্ট পুলিশ পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নিবেন বলে আশা করি।”

পরিবর্তন কতোটা এসেছে

ঢাকার রাস্তায় পর্যটক ও কালুর হাতকড়া বিতর্ক - BBC News বাংলা

বাংলাদেশে পর্যটকদের নিরাপত্তা দেবার জন্য রযেছে টুরিস্ট পুলিশ। দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় টুরিস্ট পুলিশ রয়েছে। বর্তমানে ৩২টি জেলায় ১০৪টি পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশের ৭২টি জোন কার্যালয় রয়েছে।

তাদের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে পর্যটকদের নিরাপত্তা দেয়া এবং ভ্রমণের জন্য নিরাপদ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা, কোন পর্যটক হয়রানি বা অপরাধের শিকার হলে তাদের আইনগত সহায়তা দেয়া।

কক্সবাজারে ট্যুরিস্ট পুলিশকে বেশ তৎপর ভূমিকায় দেখা গেলেও পার্বত্য অঞ্চলের অনেক এলাকায় তাদের ভূমিকা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় বলে জানিয়েছেন নিয়মিত পর্যটন অঞ্চলে ভ্রমণ করা হানিফ মাহমুদ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “কক্সবাজারে ট্যুরিস্ট পুলিশ বেশ ভালো সাপোর্ট দেয়। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় যেমন বান্দরবানে গেলে তারা আমাদের আইডি দেখে, ফোন নম্বর দেয়, কিন্তু পরে কাউকে পাই না। আমাদের একবার বান্দরবানে ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তার দরকার ছিল। কিন্তু তাদের কাউকে ফোনে পাইনি। আমরা ওইসব এলাকায় আর্মির ভরসায় ঘুরতে যাই। “

এদিকে নারী পর্যটক সৈয়দা ওয়ারদা মনে করেন পার্বত্য এলাকায় ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয় এই বিশেষায়িত পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতা এবং বিচরণের পরিধি বেশ সীমিত।

তিনি বলেন, “আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে পার্বত্য এলাকায় ট্যুরিস্ট পুলিশ অনেক রেস্ট্রিকশনে থাকে, তারা সব জায়গায় যেতে পারেন না। তবে ট্যুরিস্ট পুলিশের কাছ সাহায্য চাইলে তারা বেশ আন্তরিক থাকেন।”

তার মতে. বাংলাদেশে নারী ট্রাভেলারদের সংখ্যা বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হল নিরাপত্তা আগের চাইতে বেড়েছে।

বিদেশি পর্যটককে হেনস্তার এই খবর কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন সহকারী টুরিস্ট পুলিশ সুপার আহসান হাবিব।

মি. দাস বলেন, “আমরা বিদেশিদের নিয়ে ট্যুর এমনভাবে আয়োজন করি যেন তাদের সাথে অন্য মানুষের যোগাযোগ করতে না হয়। যেমন পুরো সময় তারা আমাদের নিজস্ব বাহনে ভ্রমণ করেন। ভালো হোটেলে থাকেন।”

“সুন্দরবনে যে বোটে তাদের ঘোরানো হয় সেখানে শুধু তারাই থাকেন। পুরো সময় আমাদের গাইড তাদের সাথে থাকেন। শহরের ট্যুরেও গাইডরা সাথে থাকেন, এজন্য তাদের হয়রানি হওয়ার কোন সুযোগ থাকেনা।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here