বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে রমনা থানায় এ মামলা দায়ের হয়।
মামলাটি দায়ের করেছেন আব্দুল মালেক নামে এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। একই সাথে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দাবি করেছেন।
মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক ছাড়াও পত্রিকাটির সাভারে নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস, সহযোগী একজন ক্যামেরা পারসন এবং প্রতিবেদনটি প্রচার-প্রকাশের সাথে জড়িত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে বলে জানান আব্দুল মালেক।
এই মামলাটি তদন্তের জন্য রমনা থানার একজন পরিদর্শককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।গত ২৬শে মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদে একজন দিনমজুরের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে উদ্বৃত করা হয়, ‘’পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’’।
এই উদ্ধৃতির সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ছিল, যে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এ সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্ট ও খবরের স্ক্রিনশট বেশ ভাইরাল হয়।
প্রতিবেদনে ওই উক্তিটি আরেক ব্যক্তির হলেও শিশুটির ছবির বিভ্রান্তি তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ওঠে।
পরে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ পোস্টটি সংশোধন করলেও এই খবরটিকে ‘মিথ্যা’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ উল্লেখ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের কথা জানান মি. মালেক।
“প্রথম আলো ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা দেশের শান্তি শৃঙ্খলা এবং দেশের ভাবমূর্তিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। দেশের ভেতরে অস্থিতিশীল ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এর বিচার হওয়া দরকার।”
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “প্রথম আলোর প্রতিবেদন যে মিথ্যা সেটা একাত্তরের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ এর (২), ৩১, ৩৫ ধারায় আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ করে এবং বিভ্রান্তি ছড়াতে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে।
এই মামলার বিষয়ে জানতে সকাল থেকে রমনা থানার একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও কারও কোন সাড়া মেলেনি।
গতকাল রাতে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টারসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য রমনা থানার সামনে গেলে তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলে তারা অভিযোগ করেন।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক নুরুল আমিন সেখানে ছিলেন। “আমরা রাত সাড়ে ১২টায় থানায় যাই। কিন্তু আমাদের কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। থানায় প্রবেশের অধিকার তো সবার আছে। কিন্তু আমরা পুলিশের কোন সহযোগিতা পাইনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কেউ কোন কথা বলেনি।”
প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে যত কথা ?
এই প্রতিবেদনটি করেছিলেন প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামান শামস। এর জেরে গত ২৯শে মার্চ ঢাকার তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের হয়।
ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে মি. শামসকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেয়া হয়। বর্তমানে তিনি আদালতের হাজতখানায় আছেন।
সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা পুলিশের বরাত দিয়ে জানান, পুলিশ তার রিমান্ড চাইবে না।
সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামে এক ব্যক্তি শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। তার অভিযোগ, প্রথম আলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ‘ভুল তথ্য, মিথ্যা পরিচয় ও মিথ্যা উদ্ধৃতি’ দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে।
মামলার এজাহারের সাথে একাত্তর টিভির প্রতিবেদনের কপিও জমা দেয়া হয়।
তবে এই মামলা দায়েরের আগে মি. শামসকে তার বাড়ি থেকে বুধবার ভোররাতে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের একদল ব্যক্তি।
সে সময় শামসের বাসায় ছিলেন ঢাকার আরেকটি পত্রিকার সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম সাব্বির।
তিনি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ভোররাত চারটার দিকে তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে সাদা পোশাকের একদল লোক বাসা থেকে শামসুজ্জামান শামসকে ধরে নিয়ে যায়। তারা নিজেদের সিআইডির টিম বলে পরিচয় দিয়ে জানিয়েছে তারা ঢাকা থেকে এসেছেন।
তারা বলেছেন, স্বাধীনতা দিবসে দ্রব্যমূল্য নিয়ে করা সংবাদের শিরোনাম এবং ছবির মধ্যে অসঙ্গতির জের ধরে, তাকে আটক করা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গ্রেফতারের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে বলেন, মামলার ভিত্তিতে প্রথম আলোর সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে তাকে কোন বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানা যায়নি। সিআইডি বা স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই আটকের বিষয়টি তাদের জানা নেই।
বুধবার ভোররাতে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর মি. শামসকে আদালতে আনা হল। এই দীর্ঘ সময় তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না বলে পরিবার অভিযোগ করেছে।
গত ২৬শে মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় প্রথম আলো খবরটি সংশোধন করে।
সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে প্রতিবেদনটি আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, প্রথমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং ব্যবহার করা ছবির মধ্যে অসঙ্গতি থাকায় ছবিটি তুলে নেয়া হয়েছে এবং শিরোনাম সংশোধন করা হয়েছে।
এদিকে শামসুজ্জামান শামসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে।