হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি : ইরানের নারীদের হিজাব পরা নিশ্চিত করতে আবারো বিতর্কিত টহল দেয়ার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সেদেশের পুলিশ। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম এই তথ্য জানিয়েছে।
রোববার পুলিশের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইরানের হিজাব আইন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে মোরালিটি পুলিশ বা নৈতিকতা রক্ষা পুলিশ আবার রাস্তায় রাস্তায় টহল দেবে।
প্রায় ১০ মাস আগে হিজাব আইন ভঙ্গের অভিযোগে তেহরানে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর মারা গিয়েছিল মাশা আমিনি। সেই মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের তৈরি হয়।
এরপর ইরানের নৈতিকতা রক্ষা পুলিশের টহল কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল।
তবে কঠোর ইসলামপন্থীরা বরাবরই দাবি করছিলেন যেন, নৈতিকতা পুলিশের টহল কার্যক্রম যেন আবার শুরু করা হয়।
ইরানের শরিয়া নির্ভর আইন অনুযায়ী, সেদেশের মেয়ে বা নারীদের অবশ্যই মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় এবং শরীর ঢেকে রাখা লম্বা, ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়।
এসব নিয়মকানুন যেন সবাই মেনে চলে, সেটা দেখার দায়িত্ব ইরানের নৈতিকতা রক্ষা পুলিশের। কেউ যদি আইন বিরোধী পোশাক পরে, তাহলে তাকে আটক করার ক্ষমতাও তাদের দেয়া হয়েছে।
ইরানের কট্টরপন্থী বার্তা সংস্থা তাসনিমে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে পুলিশের মুখপাত্র সায়েদ মোন্তাজেরলমাহদি বলেছেন, যারা পুরোপুরি আইন মেনে পোশাক পরবে না, টহল দেয়ার সময় প্রথমে তাদের সতর্ক করে দেবে পুলিশের সদস্যরা হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি।
তারপরেও তারা যদি নির্দেশনা না মানে, তাহলে পুলিশ আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে, তিনি বলেছেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২২ বছর বয়সী মাশা আমিনি যখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাজধানী তেহরানে এসেছিলেন, ঠিক মতো হিজাব না পরার অভিযোগ তুলে তাকে নৈতিকতা রক্ষা পুলিশ আটক করে।
তাকে ‘শিক্ষা দেয়ার জন্য’ একটি আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
সেই সময় অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, পুলিশের কর্মকর্তারা লাঠি দিয়ে মাশা আমিনির মাথায় আঘাত করেছে এবং তাদের গাড়িতে মাথা ঠুকিয়েছে।
সেই মৃত্যুর ঘটনায় ইরানের লাখ লাখ মানুষ পুরো দেশ জুড়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে, যাতে অন্তত ৬০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে সরকারিভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া মানুষজনও রয়েছে।
কয়েকমাস ধরে চলা সেই বিক্ষোভের সময় নারীরা হিজাব পরা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামির বিপ্লবের পর সেটাই ছিল সেদেশের ধর্ম নেতাদের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করা সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ।
সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, সাধারণ জনসমাগমের স্থানগুলোতে নারীদের হিজাব না পরার প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
ইরানের কর্মকর্তারা এর পাল্টা ব্যবস্থা নানারকম শাস্তির ব্যবস্থা চালু করে, যার মধ্যে রয়েছে হিজাব আইন মেনে ব্যবসা করা না হলে, সেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া।
যদিও ইরানের অসংখ্য মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে, কিন্তু এখনো কেউ কেউ পোশাক আইন সমর্থনও করেন।
এই বছরের শুরুতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হিজাব পরেনি, এমন দুজন নারীর দিকে দইয়ের কাপ ছুড়ে মারছে একজন ব্যক্তি।
আশেপাশের উপস্থিত ব্যক্তিরা তার ওই আচরণের প্রতিবাদ করেন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই সঙ্গে ওই দুই নারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকেই পোশাক সংক্রান্ত নানা ধরনের সামাজিক বিধিনিষেধ বা মোরাল পুলিশিং হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি করা হয় দেশটিতে। সর্বশেষ এই নৈতিকতা পুলিশের নাম ঘাশত-ই ইরশাদ বা নীতিমালা টহলদার, যারা ২০০৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে।
সেখানে মোট কতজন নারী ও পুরুষ নিয়োজিত রয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু তাদের অস্ত্র এবং আটক কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় ‘পুনঃ শিক্ষা কেন্দ্র’।
বিক্ষোভকারীদের ওপর ইরানের সহিংস দমন পীড়নের প্রতিক্রিয়ায় গতবছর যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের ওপর নৈতিকতা রক্ষা পুলিশ এবং শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি
দেশটির প্রধান বিচারপতি গোলাম হোসেন মোহসেনি শনিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। খবর আরব নিউজের।
এ ছাড়া ইরানের এক কট্টরপন্থি এমপি শনিবার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগকে নারীদের হিজাব পরার নিয়ম লঙ্ঘন করা বন্ধে ব্যবস্থাগ্রহণে আলটিমেটাম দিয়েছেন।
হোসেইন আলি হাজি দেলিগানি নামে ওই এমপি নারীদের হিজাব পরাকে ‘আল্লাহর আদেশ’ বলে বর্ণনা করে বলেন, যদি বিচার বিভাগ আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তবে ইরানের পার্লামেন্টের সদস্যরা এ বিষয়ে আইনগত শূন্যতা পূরণে একটি বিল উত্থাপন করবেন।
ইরানে নারীদের জন্য হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। নারীরা জনসম্মুখে ঠিকমতো হিজাব পরছেন কিনা তা দেখতে দেশটিতে নৈতিক পুলিশ নামে একটি বাহিনী সক্রিয় আছে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ‘হিজাব ঠিকমতো না পরার’ অভিযোগ তুলে ওই নীতি পুলিশ মাহশা আমিনি নামে ২২ বছরের এক কুর্দি তরুণীকে তেহরানে আটক করেছিল।
ওই তরুণী আটকের তিন দিন পর পুলিশের হেফাজতে মারা যায়। মারা যাওয়ার আগের তিনদিন সে কোমায় ছিল।
ওই তরুণীর পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়, গ্রেপ্তারের সময় নির্যাতনের কারণে মাহশা আমিনি অজ্ঞান হয়ে কোমায় চলে যায়।
এ নিয়ে পুরো ইরানজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। টানা কয়েক মাস ধরে চলা তীব্র ওই বিক্ষোভ ইরানের ক্ষমতাসীনদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।
বিক্ষোভের মুখে ইরান সরকার নৈতিক পুলিশ বিলুপ্ত করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। তারা বাধ্যতামূলক হিজাব আইন প্রত্যাহার এবং সরকার পতনের দাবি জানায়।
বিক্ষোভ দমনে কঠোর হওয়া ইরান সরকারের পেটোয়া বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। যাতে প্রায় এক হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন বলে দাবি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের।
গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে। তাদের মধ্যে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে।
ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চলতি সপ্তাহে জানায়, হিজাব ইস্যুতে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এক বিবৃতিতে বলা হয়, হিজাব ইসলামি আইনের একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবেই থাকবে হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি।