সৌদি সমর্থিত শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের

0
224
শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের

“আমরা এই রাসায়নিক শোধনাগার চাই না, কোনো আরব দেশের নোংরা তেল দিয়ে আমরা এখানকার এই আদি ও অকৃত্রিম পরিবেশ ধ্বংস হতে দেব না,” বলছিলেন মানসী শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের বোল।

দক্ষিণ ভারতের কঙ্কন বেল্ট, পরিবেশগতভাবে ভঙ্গুর এই অঞ্চলে রয়েছে জেলেদের গ্রাম, আমের বাগান আর প্রাচীন সব পাথরের নিদর্শন। সেখানে বিস্তৃত মালভূমি নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পেট্রোকেমিক্যাল শোধনাগার স্থাপনের যে পরিকল্পনা চলছে, তার বিরুদ্ধে হাজারো আন্দোলনরতদের একজন মানসী।

এপ্রিল মাসের শেষদিকে দক্ষিণ ভারতের রাজ্য মহারাষ্ট্রের জেলা রত্নাগিরিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়, যখন কর্তৃপক্ষ এই মেগা প্রকল্পের জন্য মাটি পরীক্ষা করা শুরু করে। প্রকল্পটি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি, বিশ্বের অন্যতম জায়ান্ট সৌদি আরামকো ও আবুধাবি জাতীয় তেল কোম্পানি – এডিএনওসির মিলিত কনসোর্টিয়াম দ্বারা নির্মিত হবার কথা।

নারীদের নেতৃত্বে হাজারো গ্রামবাসী গ্রীষ্মের প্রচন্ড উত্তাপ উপেক্ষা করে রাস্তায় এসে অবস্থান নেয়, যাতে কর্মকর্তারা এই প্রকল্পে ঢুকতে না পারে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশে নিজের মাথা ন্যাড়া করে অনশন শুরু করে।

গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হলে পুলিশ তাদের চলাফেরায় কারফিউ জারী করে এবং আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে ও টিয়ারগ্যাস ছোঁড়ে, প্রতিবাদে অংশ নেয়া নারী এবং শোধনাগার বিরোধী কর্মীদের আটক করে এবং তাদের কাউকে কাউকে অনেক দিন পর্যন্ত আটকে রাখে।

এই পুরো অঞ্চল জুড়েই এখন অসন্তোষ বিরাজ করছে। গ্রামবাসীর অভিযোগ, এই বিরাট শিল্প প্রকল্প যেটা নিয়ে প্রায় গত এক দশক ধরে প্রতিবাদ করে আসছে তারা, শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের সেটা তাদের উপর ‘অগণতান্ত্রিকভাবে ও জবরদস্তি করে’ চাপিয়ে দেয়ার কৌশল নিয়েছে সরকার।

শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের প্রতিবাদ দানা বাঁধছে

সৌদি আরবে কে এই প্রবল ক্ষমতাধর যুবরাজ মোহাম্মদ - BBC News বাংলা

গ্রামে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে শোধনাগার নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়।

“ শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের তারা বলে যে মালভূমিটি একটা অনুর্বর পরিত্যক্ত জায়গা; কিন্তু বসন্তের সময় এটা আমাদের পানির উৎস এবং এখানে আমরা সবজি উৎপাদন করি” মিজ বোল বলেন।

নিজের ট্রলার নৌকায় বসে মৎসজীবী ইমতিয়াজ ভাটকার তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেন, তিনি এই শোধনাগারের জন্য এখন প্রতিদিন তার জীবিকা হারানোর ভয়ে থাকেন।

“আমরা ১০ কিলোমিটার (৬.২ মাইল) এলাকা জুড়ে মাছ ধরতে পারবো না কারণ সমুদ্রে ক্রুড ট্যাংকার থাকবে।” মি. ভাটকার আরো বলেন “স্থানীয় ও বাইরের মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার লোক এখানকার শুধু এই একটি গ্রামেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের কী হবে?”

এলাকাটি দামী আলফানসো আমের জন্যও বিখ্যাত। এলাকার আমচাষীরা জানান, সামান্য বায়ু দূষণ ও বন উজাড় তাদের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কারণ এই আলফানসো জাতের আম বাতাস ও আবহাওয়ার উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।

এটি ঘিরে রাজনীতি
মহারাষ্ট্রে যখনই যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে শোধনাগার ঘিরে সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়েছে। ক্ষমতায় থাকার সময় এর পক্ষে, ক্ষমতার বাইরে গেলেই এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

শুরুতে এটি ছিল ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের একটি প্রকল্প, বার্ষিক ৬০ মিলিয়ন টন প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য এর আকার এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে হয়েছে।

২০১৫ সালে প্রথম ঘোষণা দেয়া হয় যে প্রকল্পটি নানার গ্রামে স্থাপন করা হবে, বর্তমান রত্নাগিরি জেলার বারসু গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিল সেটি। কিন্তু নানার গ্রামের মানুষ, কাউন্সিল ও পরিবেশবাদী গ্রুপগুলোর প্রচন্ড বিরোধীতার মুখে সেখান থেকে সরে আসতে হয় কর্তৃপক্ষকে।

রাজ্যের আগের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ভব থ্যাকারে গত বছর প্রকল্পটি আবারো বারসু গ্রামে করার উদ্যোগ নেন শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের।

কিন্তু এখন ক্ষমতার বাইরে এসে তিনি তার অবস্থান বদলে স্থানীয়দের পক্ষ নিয়েছেন।

রাজ্যের বর্তমান সরকার যা বিজেপি এবং মি. থ্যাকারের দলের একাংশ নিয়ে গঠিত, তারা বলছে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

“এটা দূষণহীন একটি গ্রিন রিফাইনারি। শিল্প মন্ত্রী হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব জনগণের মধ্যে বাইরে থেকে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তা দূর করা” – রাজ্যের একজন মন্ত্রী উদয় সামান্ত বলছিলেন বিবিসিকে।

🌀মোকাঃ মিয়ানমারে নিহত বেড়ে ২০২ - WNL News

এছাড়া এখানে থাকা পেট্রোগ্লিফ বা পাথরে আঁকা প্রাচীন শিল্পকর্ম যা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করার কথা, সেগুলোর ক্ষতি হবে না বলেও দাবি করেন এই মন্ত্রী।

মি. সামান্ত জানান যে, ৫ হাজার একর জমি নিয়ে প্রকল্পটি নির্মাণ হবে তার ৩ হাজার একর এরইমধ্যে সরকার অধিগ্রহণ করেছে।

অবশ্য বিবিসি তার দাবির পক্ষে খুব একটা প্রমাণ পায়নি।

যেমন মাটি পরীক্ষা করা হচ্ছে যেখানে, তার মাত্র কয়েক মিটার দূরেই এই মালভূমিতে থাকা ১৭০টি পেট্রোগ্লিফের কয়েকটির অবস্থান শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের। এ নিয়ে অন্তত ছয়টি স্থানীয় গ্রাম কাউন্সিলের অনাপত্তিপত্র কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে গেছে এই বলে যে, এখানকার জমিতে এই গ্রামবাসীদের অধিকার নেই।

কিন্তু স্থানীয়রা বলছে তাদের অত্যন্ত কম দামে এখানে বিনিয়োগকারীদের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়েছে শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের, যাদের মধ্যে আছে রাজনীতিবিদ, পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারি চাকুরিজীবি, এবং তারা জানতোও না যে এটি শোধনাগার প্রকল্পে দেয়া হবে।

“সরকার স্থানীয় মানুষদের পরিবর্তে এই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণ করতে দিচ্ছে দু’শোর মতো বিনিয়োগকারীদের।” বলছিলেন সত্যজিৎ চাওয়ান, যিনি ৬ রাত জেল খেটে এসেছেন সামাজিক মাধ্যমে শোধনাগার বিরোধী পোস্ট দিয়ে জনগণকে প্রতিবাদে অংশ নিতে বলে।

শোধনাগার নিয়ে এখানকার চিন্তাভাবনা ভৌগলিক অবস্থান, শ্রেণী ও আদর্শের দিক থেকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে।

গ্রাম থেকে শহরে আসলে রাজাপুরের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুরুজ পেডনেকার জোর দিয়ে বলেন এই প্রকল্প পুরো রত্নাগিরির ভাগ্য বদলে দেবে, যা দেশের অন্যতম ধনী প্রদেশে থেকেও শিল্পকারখানার দিক থেকে দুর্বল অবস্থানে।

সরকারি হিসাব বলছে এর ফলে মহারাষ্ট্রের জিডিপি ৮.৫% বেড়ে যাবে।

“সমস্ত তরুণ-তরুণীরা প্রতি বছর জীবিকার তাগিদে মুম্বাই আর পুনে যায়,” বলেন মি. পেডনেকার। “গ্রামগুলো শূন্য হয়ে পড়ে কারণ এখানে চাকরি নেই। কিন্তু যদি শোধনাগারটি হয় তাহলে অন্তত ৫০ হাজার লোকের চাকরি হবে, জনসংখ্যা বাড়বে যা এখানকার ব্যবসায়ীদের সাহায্য করবে। আমরা সেটা কেন হতে দেব না?”

তার মতো একই চিন্তা শহরের অনেক লোকের যাদের জীবিকা সরাসরি এই প্রকল্প দ্বারা প্রভাবিত হবে না। কিন্তু গ্রামবাসীদের যুক্তি আলাদা।

“যে সমস্ত চাকরির কথা বলা হচ্ছে এগুলো সব পাবে শিক্ষিত ডিগ্রীধারীরা, কোনো জেলে তো আর পাবে না। আমাদের এসব চাকরির দরকার নেই,” বলেন মি. ভাটকার।

মিজ বোলে বলছিলেন যদি স্থানীয়রা চাকরি পায়ও, সেটা হবে একেবারেই নিচু সারির সুইপার বা নিরাপত্তারক্ষী শ্রেণীর।

রাজ্যজুড়ে অবশ্য গ্রামবাসীদের আন্দোলনে সমর্থন বাড়ছে শোধনাগারের বিরুদ্ধে অবস্থান ভারতীয়দের।

সম্প্রতি পুনেতে এক সভায় রাজ্যের লেখক, কবি, আন্দোলনকর্মী ও বিক্ষোভকারীরা এক হয়ে শপথ করেন যে জনগণকে এক করে তারা সরকারের উপর চাপ বাড়াবেন, যাতে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।

“আমাদের চেষ্টা হবে যারা এই প্রকল্পের পক্ষে সেসব রাজনীতিবিদ ও দলকে ভোট না দিতে মানুষদের অনুরোধ করা,” বিবিসিকে বলেন মি. চাওয়ান।

১৯৯০ সালের দিকে এনরন থেকে শুরু করে ২০০০ সালে পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের ফরাসী উদ্যোগসহ টাটা ও রিলায়েন্সের মতো বড় বড় ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নানা শিল্প প্রকল্প কঙ্কন থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছে এখানকার মানুষদের প্রতিবাদের মুখে।

এই শোধনাগার প্রকল্পটিও একই ভাগ্য বরণ করবে কি না তা ভবিষ্যত বলে দেবে। তবে গ্রামের পর গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এটি প্রতিহত করতে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবেন তারা।