একটা কাঁচা মরিচের দাম এক টাকা : নিত্য-পণ্যের ঊর্ধ্বগতির তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে কাঁচা মরিচ। ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা গিয়েছে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মরিচের দাম তিন গুণ ছাড়িয়েছে। বছর ব্যবধানে দাম বেড়েছে ছয় গুণ।
টানা দুই মাস খরা, এরপর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে উৎপাদন ব্যহত হওয়ায় পণ্যটির দাম বেড়ে গিয়েছে বলে দাবি করেছেন কৃৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
তবে দাম এতো বেশি বেড়ে যাওয়ার যে খবর প্রকাশ হচ্ছে একে গুজব বলে দাবি করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা।
অথচ রবিবার দুপুরে ঢাকার কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে- কাঁচামরিচ খুচরায় ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা কি না দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি।
পাইকাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে একটা কাঁচা মরিচের দাম এক টাকা এই মরিচ বিক্রি করছেন ৫০০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে।
একারণে ক্রেতারা আগে যেখানে আধা কেজি বা এক কেজি মরিচ কিনতেন, তারা এখন ৫০ গ্রাম বা ১০০ গ্রামের মতো মরিচ কিনছেন।
১০ টাকা ২০ টাকা খুচরায় মরিচ কেউই বিক্রি করছেন না।
নূরের চালা কাঁচাবাজারে গৃহিণী তাসলিমা আক্তার ৫০ গ্রাম মরিচ কিনেছেন ৩০ টাকায়। তার ব্যাগে সেই মরিচ গুণে দেখা গিয়েছে ৩৫টির মতো মরিচ।
এরমধ্যে ৫/৬টি ব্যবহারযোগ্য না। সে হিসেবে প্রতিটি মরিচের দাম পড়েছে প্রায় এক টাকার মতো।
এ অবস্থায় রান্নায় কাঁচা মরিচের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ার কথা জানান মিসেস আক্তার।
“তিরিশ টাকায় যে মরিচ কিনেছি ওটা তো দেখার মতোও না। দুই সপ্তাহ আগে ১০ টাকায় এর চেয়ে বেশি মরিচ পেতাম। এই কয়টা কিনছি ভাতের সাথে কাঁচা খাওয়ার জন্য। তরকারিতে তো মরিচ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শুকনা মরিচ, গুড়া মরিচ দিয়েই চালাতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম দেখলে মনেহয় গলায় পাড়া দিয়ে দাম রাখছে।”
জীবদ্দশায় মরিচের এমন দাম দেখেনি কেউ একটা কাঁচা মরিচের দাম এক টাকা
বৃষ্টির কারণে উৎপাদন কম এবং ঈদের ছুটিতে পরিবহন সংকটের কারণেই দাম বেড়ে গিয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
“ঈদের কারণেই মরিচের দাম বাড়তি। ঈদে গাড়ি ঘোড়া আসতে পারে না। বৃষ্টি-বাদলের কারণে রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়েছে, এজন্য গাড়ি আসতে পারে নাই। পাইকাররা মরিচ হাটে পায় না, এজন্য তারাও আনতে পারে না। আমরাও পারি না,” বলেন নূরের চালা কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী কালি কান্ত।
প্রায় ২৫ বছরের সবজি বিক্রির ব্যবসায় তিনি কাঁচামরিচের দাম কখনও এতোটা বাড়তে দেখেননি।
ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলা কাঁচা মরিচ উৎপাদনে সমৃদ্ধ হলেও সেখানকার বাসিন্দাদেরও রবিবার ৬০০ টাকা কেজিতে কাঁচা মরিচ কিনতে হচ্ছে। শনিবার এই দাম ছিল আরও বেশি।
সেখানকার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১,০০০ টাকা দরেও বিক্রি হয়েছে।
জীবদ্দশায় কাঁচামরিচের দাম কখনও এতোটা বাড়তে দেখেননি ক্রেতা সোহান আহমেদ, “কাঁচা মরিচের কেজি গরুর মাংসের কেজির চাইতে বেশি। এটা তো কখনও ভাবিওনি। এই টাকায় তো কখনই মরিচ কেনা সম্ভব না। পরে আমি বোম্বাই মরিচ কিনেছি, শুকনা মরিচ দিয়ে কাজ চালাচ্ছি।”
কাঁচা মরিচের দাম এক ধাক্কায় এতোটা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।
শৈলকূপার কাঁচা মরিচের খুচরা ব্যবসায়ী নবীন মিয়া নিজেই বিপাকে আছেন তার কাছে থাকা মরিচ বিক্রির অভাবে নষ্ট না হয়ে যাচ্ছে বলে।
“শনিবার সকালে মরিচের পাইকারি রেট ছিল ৮০০/৮৫০ টাকা। একটা কাঁচা মরিচের দাম এক টাকা তাই খুচরায় ৯০০/১০০০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়েছে। বৃষ্টিতে অনেক মরিচ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পানির জন্য গাড়ি আসতে পারছে না। দুপুরের মধ্যে আমার টুকরি খালি হয়ে যাওয়ার কথা। এখন কেউ কিনেই না। আজকে লসে ছাড়তে হচ্ছে, উপায় নাই।”
ঢাকার খুচরা বাজারেও সেটার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। বেশিরভাগ দোকানে কাঁচামরিচ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। যে কয়জন বিক্রি করছেন। তাদেরকে দেখা গিয়েছে ছোট টুকরিতে সামান্য ক’টি মরিচ নিয়ে বসেছেন।
ভ্যানের সবজি বিক্রেতা মাহাদি হাসান জানান, “মরিচের এতো দাম, আজকে আর মরিচ আনি নাই। কালকেরটাই বিক্রি হচ্ছে না। সবাই ৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম করে নিচ্ছে। কাঁচা মরিচের দাম বাড়ায় আমাদের তো কোন লাভ নাই। আমরা যে দামে কিনবো, ওই হিসাবেই বিক্রি করবো।”
21খরা/বৃষ্টি
কৃষকদের দাবি এপ্রিল, মে এবং জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত খরার একটা কাঁচা মরিচের দাম এক টাকা থাকায় মরিচের কোন ফলন হয়নি, যার কারণে বাজারের এমন দুর্দশা।
ফরিদপুর সদর উপজেলার শোলাকুন্ড গ্রামে এ বছর অন্তত ১০০ একর জমিতে মরিচ চাষ হলেও উৎপাদন বলতে গেলে শূন্য।
স্থানীয় কৃষক কলম চকদার বলেন, “খরাতে সব গাছে কুঁকড়া লেগে গিয়েছিল, মানে গাছ বাড়ছিল না। মাটিতে রস নাই, গাছ ছোট হয়ে কোন ফল ধরেনি। আগে এই সময়ে এক একর জমি থেকে প্রতি সপ্তাহে ২০/৩০ মন মরিচ তুলতাম। আর এবারে দুই তোলা মরিচও ওঠেনি। পুরাই জিরো (শূন্য)। লস তো হয়েছে অনেক, কিন্তু প্রকৃতির খেলায় কাকে দোষ দেবো?”
এ অবস্থায় মরিচ চাষীরাই বাজার থেকে মরিচ কিনে খাচ্ছেন বলে তিনি জানান।
তবে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় মরিচ গাছগুলোয় প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে, খুব শিগগিরই উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এবং কাঁচা মরিচের দাম আগের মতো নাগালের মধ্যে ফিরবে বলে তিনি মনে করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রধান কৃষিতত্ত্ববিদ স্বদেশ কুমার পাল জানিয়েছেন, সাধারণত বর্ষার মৌসুম, বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যখন বেশি থাকে তখন মরিচ গাছের ফুল পড়ে যায়, গাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষকরা সেভাবে গাছের পরিচর্যা করতে পারেন না, মরিচ সংগ্রহ কমে যায়।
সব মিলিয়ে সার্বিক উৎপাদন ব্যহত হওয়ার কারণেই বর্ষা মৌসুমে বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যায় বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, “এপ্রিল থেকে গেল তীব্র খরা, আবার এখন মুষলধারায় বৃষ্টি। একটা কাঁচা মরিচের দাম এক টাকা তখন মরিচ গাছ বাড়তে পারে নি। এখন যে কটায় ফুল এসেছে, সেগুলো বৃষ্টিতে ঝরে যাচ্ছে। এজন্যই ফলন কম। প্রতি বছরই এমন হয়। তবে এবারের মতো দাম কখনও বাড়েনি। বৃষ্টিপাত একটু কমে এলেই দাম পড়ে যাবে। তাছাড়া আমদানি তো হচ্ছেই।”
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং এর অতিরিক্ত পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন দাবি করেন, কাঁচা মরিচের দাম এতোটা বেড়ে যাওয়ার খবর সম্পূর্ণ গুজব।
“আমি তো দেখলাম কাঁচা মরিচ এখন ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। একটা কাঁচা মরিচের দাম এক টাকা ৬০০ টাকা, ১০০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়ার ঘটনা গুজব বলেই মনে হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে মরিচের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এতো বাড়েনি।”
কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, সর্বনিম্ন ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মরিচ গাছের বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে মরিচ গাছের পাতা ঝরে যায় এবং গাছ পচে যায়।
সেক্ষেত্রে রবি মৌসুম কাঁচা মরিচ ফলনের সবচেয়ে উপযোগী সময়। বাকি সময়ে বিশেষ করে বর্ষায় উৎপাদন সবচেয়ে কমে যায়।