বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে যেভাবে ৭ লাখ কোটি টাকা হয়েছে

0
293
বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা

বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা : কটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে দেশের কোন খাতে কোথায় কত ব্যয় হবে সরকারের এই আর্থিক পরিকল্পনার চিত্র প্রতিফলিত হয় বাজেটের মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট থেকে শুরু করে গত বছর পর্যন্ত যেসব বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে দেখা যায় সময়ের সাথে প্রত্যেকটা বাজেটের আকার বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটে টাকার পরিমাণ বাড়লেও অর্থনীতির অনুপাত হিসেবে বাজেট বাড়েনি। তাদের মতে, সময়ের পরিবর্তনে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘গুণগত’ যে পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি।

গত পাঁচ দশকের বাজেট প্রণয়নের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের ওপর নির্ভর করে শিল্পায়নের কথা চিন্তা করা হতো, সরকার বদলের সাথে সাথে সেখানে রাষ্ট্রের জায়গায় ব্যক্তিখাতের ভূমিকাকে বড় করা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে যেভাবে ৭ লাখ কোটি টাকা হয়েছে

বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে যেভাবে ৭ লাখ কোটি টাকা হয়েছে

মানব সম্পদের উন্নয়ণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকার বাজেটে নানা ধরণের বরাদ্দ দিয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রথম জাতীয় বাজেট উপস্থাপিত হয় ১৯৭২ সালের ৩০শে জুন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- দেশের প্রথম বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে এই বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি।

স্বাধীনতার পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের তৈরি ওই বাজেটটি বাংলাদেশের একটি ‘ঐতিহাসিক বাজেট’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন অর্থনীতিবিদেরা।

“মাত্র ছয় মাস হয়েছে দেশ মুক্ত হয়েছে, এরকম একটা সময়ে ওই বাজেট হয়। যেখানে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল না, রাজস্ব আদায় সেভাবে ছিল না। সরকারের বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারটিও অনিশ্চিত ছিল,” অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ।

“সম্পদের অনিশ্চিত পরিস্থিতির ভেতরে একদিকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিষয় ছিল, এর পাশাপাশি যেসব অবকাঠামো ভগ্ন অবস্থায় ছিল – হাজার হাজার সেতু, একইসাথে কৃষি শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুনর্বাসন বা পুনর্গঠনের বিষয় ছি,” বলেন মি. ভট্টাচার্য ।

দেশের প্রথম সেই বাজেট আকারে ছোট হলেও ‘গুণমানসম্পন্ন’ একটি বাজেট সেসময় তৈরি হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বাজেটকে “সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার বাজেট’ হিসেবে বর্ণনা করছেন ঢঅকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ।

“তখন পুনর্বাসনের বিষয় ছিল। মিশ্র অর্থনীতির মধ্যে রাষ্ট্রীয় খাতের প্রাধান্য রেখে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের বাজেটগুলো হয়েছে। যাতে বৈষম্য কমানোর তাগিদ ছিল, কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ ছিল। বৈদেশিক প্রভুত্ব কমানোর তাগিদ ছিল। স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদ ছিল,” বলেন অধ্যাপক আকাশ।

তখন বৈদেশিক সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে সরকার অনেক সতর্ক ছিল এবং বাজার প্রয়োগ না করে রেশন ও ন্যায্যমূল্যের উপরে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে।

তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন মোট তিনটি বাজেট পেশ করেন। সেসব বাজেটে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৭৮৬ কোটি টাকা, ৯৯৫ কোটি টাকা এবং ১ হাজার কোটি টাকা (প্রায়)।

স্বাধীনতার ৫১ বছরের ব্যবধানে ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল সেটির আকার হয়েছিল ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

এবার পঞ্চমবারের মতো বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সম্ভাব্য আকার প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা।

বেড়েছে ব্যক্তিখাতে নির্ভরতা বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা

বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে যেভাবে ৭ লাখ কোটি টাকা হয়েছে

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটের ক্ষেত্রে প্রথম বড় ‘পলিসি শিফট’ বা ‘নীতির পরিবর্তন‘ হয়েছে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের ভূমিকাকে সীমিত করা হয়েছে ও ব্যক্তিখাতের ভূমিকাকে বড় করা হয়েছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছিলেন “বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের জন্য যে দায়িত্বের জায়গা আছে সেটা ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিখাতের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রথমে এটা ছিল মালিকানার ক্ষেত্রে এবং পরে এটা বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এটা পরিলক্ষিত হয়েছে। এবং তারপরে বৈদেশিক সম্পর্কের মাধ্যমে।”

জিয়াউর রহমান তার আমলের বাজেটে তিনি মিশ্র অর্থনীতির কোন কোন অংশ রাখার চেষ্টা হয়েছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সেখানে ব্যক্তিখাত এবং রাষ্ট্রায়াত্ব খাতকে সমান গুরুত্বদেয়া হয়েছিল।

“রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কলকারাখানাগুলো ব্যক্তিখাতে ফেরত দেয়া প্রসঙ্গে বাজেটে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন ‘আমি যদি কোনও কারখানা লাভজনক পাই ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব হবার পরও যদি লাভজনক পাই কেন আমি ব্যক্তিখাতে দিয়ে দেব, তখন তো লাভটা দিয়ে শিক্ষা সামাজিক খাতে ব্যবহার করতে পারবো” বলেন মি. আকাশ।

বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং বাজার অর্থনীতির ধারা জোরালো রূপ পায় জেনারেল এইচএম এরশাদ সরকারের সময়। যার প্রতিফলন দেখা যায় বাজেেট।

অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন মনে করেন “সত্তরের দশকের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা থেকে যে বিভিন্ন সরকার সরে আসতে থাকে তা বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে। এবং আস্তে আস্তে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে গেছে সরকার”।

মানবসম্পদের ওপর জোর

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কয়েক দশকের বাজেট পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারা যায় যে বাংলাদেশে অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মনোযোগ বেড়েছে। পাশাপাশি বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পও হাতে নিচ্ছে৷

বলছিলেন –“ ক্রমান্বয়ে একটা ঐক্যমত দেশের ভিতরে গড়ে উঠেছে – মানবসম্পদের দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষা স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। এটা আশির দশকের দিক থেকে দেখেছি,” বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

সে সময় থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা স্বাস্থ্যের দিকে অগ্রগামী ছিল বলে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা ।

“বর্তমান সরকারের ১৫ বছরে দেখেছি আমরা ভৌত অবকাঠামোর প্রতি প্রচুর জোর দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু ইত্যাদি এর সাথে বিদ্যুতের ওপরেও জোর দেয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে যেটা হয়েছে কতগুলো বিষয়ে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ব্যাপারে ঐক্যমত বিরাজ করে”।

বাংলাদেশ যে মানবসম্পদে জোর দিচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, কৃষির বহুবিধিকরণ, যান্ত্রিকীকরণ এসব বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করছে সরকারগুলো – এটা ইতিবাচক দিক বলে মনে করেন মি. ভট্টাচার্য।

তার মতে সাম্প্রতিককালে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটা ধারাবাহিকতা বা গতানুগতিকতা লক্ষ্য করা যায়।

“দশ শতাংশ করে রাজস্ব বাড়বে, দশ শতাংশ করে খরচ বাড়বে। প্রত্যেক খাতে এটাকে দেয়া হবে। বড় বড় প্রকল্প কিছু থাকবে সেটাতে ৭০ শতাংশ চলে যাবে বাকি শতাংশ অন্যান্য প্রকল্পকে ভাগ করে দেব- এভাবে কাজগুলো হচ্ছে” বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।